মাহমুদ দারবিশ ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি (১৯৪১-২০০৮) শুধু ফিলিস্তিন নয়, গোটা আরবজুড়েই তার সুখ্যাতি। মাহমুদের কবিতায় ফুটে উঠতো ফিলিস্তিনের মানুষের হাহাকার, অধিকারহীনতা, ইসরায়েলের ছুঁড়ে মারা রকেটের ইতিবৃত্ত কবিতার পরতে পরতে।
তিনি কবিতা লিখেছেন— স্বপ্ন দেখি পৃথিবীর হৃদয় তার মানচিত্রের চেয়েও বড়। কিন্তু পৃথিবীর মানুষের হৃদয় তো অত বড় নয়। তাই ১৯৪৮ সালে ইসরাইলি সৈন্যদের ফিলিস্তিন দখলের সময় এক ভয়াবহ রাতে আক্রান্ত হয় দারবিশের এ ছোট্ট গ্রামটিও। অজস্র ফিলিস্তিনির মতো তিনিও হারিয়েছিলেন তার গৃহ, গ্রাম, শৈশব। মাহমুদ দারবিশ প্রথম কবিতা আবৃত্তি করেন নতুন ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম উদযাপন অনুষ্ঠানে। প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে স্কুল ছাত্র দারবিশ স্বরচিত কবিতা পড়ছিলেন-
“তুমি চাইলেই সোনালি রোদে খেলা করতে পারো
তুমি চাইলেই হাতের নাগালে পাও আলোকিত পুতুল
কিন্তু আমার তা নেই।
তোমার আছে ঘর, আমার কিছুই নেই।
তোমার আছে উৎসব আর উদযাপন, কিন্তু আমি তার দেখা পাই না”।
এ কবিতা শুনে পরদিন ইসরাইলি সামরিক সরকারের লোকেরা তাকে ডেকে নিয়ে শাসায়। তাকে বলা হয় ভবিষ্যতে এ ধরনের কবিতা লিখলে তার বাবার চাকরি যাবে।
এভাবে দীর্ঘসময়ের পরিক্রমায় একসময় ফিলিস্তিনি সাহিত্যের একটা আদল দাঁড়িয়ে যায়, হয়ত তাদেরও অজান্তে। তবে ফিলিস্তিনি সাহিত্যের প্রাণপুরুষ গাসসান কানাফানি এই সাহিত্যকে আরো একটু মাত্রা দিয়ে নাম দেন— ‘প্রতিরোধ সাহিত্য’। পরবর্তীতে মাহমুদ দারবিশকে কবিতা না লিখতে বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেয় দখলদার বাহিনীর কর্মকর্তারা কিন্তু বিপ্লবী, সংগ্রামী মাহমুদকে ইসরায়েল আটকে রাখতে পারেনি, কলমের আঘাতেও সেইবার ইসরায়েল পরাজিত হয়।
ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের সতেরো বছর বয়সে তার মনের দরজায় প্রেম এসে কড়া নাড়ে তবে তা একই গোত্র আর ধর্মের মধ্যে নয়। সমাজ, ধর্মের রীতিনীতিকে তোয়াক্কা না করে সাহসী মাহমুদ দারবিশ প্রেমে পড়েন ইহুদি সুন্দরী রমনী। তার নাম ছিল মূলত তামার বেন এমি। দারবিশ ভালোবেসে নাম দেয় রিটা। নিত্যনৈমিত্তিক আসা যাওয়ার কালে রিটার সাথে পরিচয় হয় মাহমুদ দারবিশের। দিন যেতে যেতে সখ্যতা বাড়তে থাকে মাহমুদ রিটার। প্রথমবার তিনি তাঁর প্রেমিকার উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন, আমার গোত্রের সম্মান, আমার শহরের জাত এবং সব প্রথার শৃঙ্খল থাকা সত্ত্বেও আমি তোমাকে ভালোবাসি এভাবে প্রায় দু বছর পর একদিন মাহমুদ দারবিশ আবিষ্কার করল রিটা ইহুদি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন সক্রিয় গুরুত্বপূর্ণ সদস্যা হয়ে কাজ করেন। মাহমুদ জানতে পারার পর মনে পড়তে লাগল ইসরায়েলের চালানো রাতের আধাঁরে অমানবিক আগ্রাসন,নৃশংসতা, গনহত্যা সহ আবালবৃদ্ধবনিতার গগনবিদারী আর্তনাদ!
মূহুর্তেই হাসোজ্জল হ্নদয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় পরে তিনি লিখলেন “Between Rita and my eyes,There is a rifle”
তখন গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয় তার লেখা ‘রিটা অ্যান্ড দ্য রাইফেল’ কবিতাটি।
মাহমুদ দারবিশ তার লেখা তিনটি কবিতায় চিত্রিত করেছেন প্রেমিকা রিটাকে।
তিনি লিখেছিলেন —
‘আমি আমার জাতির সাথে বেইমানি করে, আমার শহর এবং তার পরাধীনতার শিকলগুলির বেদনা ভুলে গিয়ে হলেও তোমাকে ভালোবাসি। মাহমুদ দারবিশকে ভালোবাসা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, “তুমি আমাকে মেরে ফেলছ আবার তুমিই আমাকে মৃত্যু থেকে বিরত রাখছো। এটাই হচ্ছে ভালোবাসার সংজ্ঞা”।
দারবিশ আবার লিখেন —
‘তোমার কাছে কিছুই ছিলো না যেই প্রেমটা, আমার কাছে সেইটা আমার অস্তিত্ব ছিলো’। প্রেমিক মাহমুদ দারবিশ ইহুদি নারী রিটার প্রেমে মশগুল মাতোয়ারা এবং দিশেহারা! মাহমুদ দারবিশ তাঁর জন্মভূমিকে মৃত্যুপুরী করে দেওয়া ইসরায়েলের নৃশংসতার ঘটনা মাহমুদের মনে বিদ্ধ হতে থাকে…
তার মৃত্যুর আগে তাদের শেষ দেখা হয় প্যারিসে ১৯৯২ সালে। যখন সে শেষবারের মতো রিটার জন্য লিখেছিলেন, রিটা উন্টার। যার শেষ লাইনে তিনি লিখেছিলেন, আমার সব অজ্ঞতা থেকে আমি তোমাকে স্বদেশ বলেছি এবং আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের দেশ কেড়ে নেয়া হয়েছে জোর করে বারবার। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ নিয়ে কলম হাতে, খসখসে সাদা কাগজে রিটার এতোদিনের প্রেমের জলাঞ্জলি দিয়ে মাহমুদ দারবিশ এতোটা দিনেও যে রিটার হৃদয় দখল করতে পারিনি সে ব্যর্থতায় লিখেছিলেন অশ্রু নয়নে-
❝দেশ দখলের চেয়ে, হ্নদয় দখল করা কঠিন!❞
শব্দে-বাক্যে:
মোহাম্মদ সায়েম
শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, কক্সবাজার সরকারি কলেজ
ও ইতিহাস গবেষণা সহকারী (ড.হাবিবুর রহমান,
কাতার সরকারের ইতিহাস বিষয়ক উপদেষ্টা)
সূর্যোদয় :- ৫:১০ | সূর্যাস্ত :- ৬:৪৯ |
নাম | সময় |
ফজর | ৪:১৫ |
যোহর | ১২:১০ |
আছর | ৪:৫০ |
মাগরিব | ৬:৪৫ |
এশা | ৮:১৫ |