শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০৮ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ

টেকনাফে মানবপাচার ঠেকাতে অভিযান, এক মাসে উদ্ধার ৩৪৭ জন, আটক ৪৭

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৫, ১২:৩৬ অপরাহ্ন

কক্সবাজারের টেকনাফ কেন্দ্রিক মানবপাচার ঠেকাতে একের পর এক ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে বিজিবি, কোস্টগার্ড, র‌্যাব সহ অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। কখনো গহীন পাহাড়ে আবার কখনো সাগর উপকূলে এই অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।
এসব অভিযানে গত ১ মাসে ১৩টি অভিযানেই ৩৪৭ জন ভূক্তভোগীকে উদ্ধার এবং ৪৭ জন পাচারকারীকে আটক করা হয়েছে। প্রায় একমাসের চেষ্টায় চক্রের অন্যতম এক নাটের গুরুকে গ্রেফতারে সমর্থ হয়েছে যৌথ বাহিনী। চিহ্নিত হয়েছে এই চক্রে জড়িত ভিনদেশীরাও।

সর্বশেষ মঙ্গলবার মধ্যরাতে টেকনাফের সাগর উপকূল মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন অভিযান চালিয়ে পাচারের আগমূহুর্তে ২৯ জনকে উদ্ধার করেছে বিজিবি। এসময় আটক করা হয়েছে চক্রের ৩ সদস্যকে।
বিজিবির টেকনাফস্থ ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আশিকুর রহমান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানিয়েছেন, মঙ্গলবার ভোরে রাজাছড়ার গহীন পাহাড়ে সশস্ত্র পাচারকারীদের গোপন আস্তানা গুড়িয়ে দেওয়ার পর জিম্মিশালা থেকে ৬ জনকে উদ্ধার করে অস্ত্র ও গুলি সহ একজনকে আটক করা হয়। কিন্তু অভিযানে পালিয়ে যায় পাচারকারি চক্রের ৮ সদস্য। এই অভিযানে সূত্র ধরে বিজিবি সমুদ্র উপকূলের নজরধারি বাড়ায়। গোয়্দো তথ্যে জানা যায় অভিযান চলাকালে পালিয়ে যাওয়া চক্রের সদস্যরা কিছু ভুক্তভোগীকে সমুদ্রপথে পাচারের চেষ্টা করবে। সন্ধ্যায় মেরিন ড্রাইভ সৈকতের কৌশলগত বেশকিছু পয়েন্টে বিজিবি’র বিশেষ টহল দলের সদস্যরা নিবিড় নজরদারি শুরু করে। রাত গভীর হলে সমুদ্র উপকূলে থেকে সন্দেহজনক গতিবিধি লক্ষ্য করা যায়। মানব পাচারকারী চক্র গোপনে ২৯ জন ভুক্তভোগীকে একটি নৌযানে গভীর সাগর দিয়ে পাচারের জন্য প্রস্তুতকালে ২৯ জনকে উদ্ধার করে। ঘটনাস্থল থেকে মানব পাচারের দায়ে চক্রটির ৩ জনকে আটক করা হয়।

আটকরা হলেন, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মহেশখালীয়াপাড়ার মৃত মোজাহার মিয়ার ছেলে মো. সলিম (৩৫), মৃজিবুর রহমানের ছেলে নুরুল আবছার (১৯), কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করিমুল্লাহর ছেলে মনসুর আলম (২২)।
অভিযানে সময় পালিয়ে যাওয়া ৯ থেকে ১০ জনের মধ্যে ৩ জনকে শনাক্ত করার তথ্য জানিয়েছে বিজিবি। এর হলো, মহেশখালীয়া পাড়ার মাহমুদুল হক (৩১), সৈয়দুল ইসলাম (৩৭), আজিজুল হক (৩০)।
অভিযানে ১ টি চাকু, ১টি মোটর সাইকেল, ১টি ইঞ্জিন চালিত সাম্পান নৌকা উদ্ধার করা হয়েছে।
বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, ‘মঙ্গলবার দিনটি টেকনাফ সীমান্তে মানব পাচারকারী ও সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রগুলোর জন্য একটি চরম দুঃসংবাদ বহন করে এনেছে। আমরা ভোরে পাহাড়ের দুর্গম চূড়া থেকে জিম্মি উদ্ধার করেছি এবং সন্ধ্যায় সমুদ্র উপকূলে মানব পাচার বানচাল করেছি। সর্বশেষ দুইটি সফল মানব পাচার বিরোধী অভিযানের মাধ্যমে বিজিবি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, টেকনাফ সীমান্তের পাহাড় থেকে সমুদ্রের জলসীমা পর্যন্ত কোনো অপরাধীর জন্য এক ইঞ্চি জায়গাও নিরাপদ নয়। মানবতা বিরোধী এমন জঘন্য অপরাধ আমরা কোনোভাবেই বরদাশত করব না। আমাদের এই ধারাবাহিক ও কঠোর নজরদারি এবং অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
উদ্ধার ২৯ জন ভুক্তভোগীকে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শেষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। আটক ৩ মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে মামলা রুজু করার বিষয়টি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন বলে জানান তিনি।
এর আগে মঙ্গলবার ভোরে টেকনাফের গহীন পাহাড়ে মানবপাচারকারিদের জিম্মিশালা থেকে ৬ জনকে উদ্ধার করে বিজিবি। এসময় অস্ত্র ও গুলি সহ একজনকে আটক করা হলেও পালিয়ে গেছে পাচারকারি চক্রের ৮ সদস্য।
সরেজমিন জানা গেছে, টেকনাফের বাহারছড়ার কচ্ছপিয়া ও বড়ডেইল এলাকায় গড়ে উঠেছিল একাধিক গোপন বন্দী শিবির। পাচারকারী চক্রের নেতৃত্বে রয়েছে আবদুল আলী (১২ অক্টোবর কারাগারে), মো. হোসেন, সাইফুল ও নিজাম নামের চার ব্যক্তি। তাদের অধীনে কাজ করছে শতাধিক দালাল, যাদের মধ্যে রয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মাঝি-মাল্লা, এমনকি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কিছু মানুষও। সবুজ পাহাড়, নীল সমুদ্র আর নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা বাহারছড়া তাদের কারণে প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতীক থেকে মানব পাচার ও অপহরণের এক ভয়ঙ্কর কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ফরিদ উল্লাহ বলেন বলেন, ‘এই ইউনিয়নের ১৩ হাজার মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। সন্ধ্যার পর কেউ বাইরে বের হয় না। এখানে আরও একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চৌকি স্থাপন করা জরুরি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।’
তিনি আরও বলেন, পর্যটকদের মেরিন ড্রাইভে সন্ধ্যার পরে একা যাতায়াত থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে টেকনাফের বাহারছড়া পাহাড়ি সংলগ্ন বড়ডেইল, গর্জন বাগান, বাঘঘোনা, কচ্ছপিয়া এলাকায় সর্তক থাকতে হবে। তিনি বলেন, “যদি সম্ভব হয় এসব এলাকায় সর্তক বার্তা টাঙিয়ে দেয়া উচিত।”
এদিকে যৌথ অভিযানের মধ্যেই গত ২৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার বিষয়ক প্রতিবেদন ট্রাফিকিং ইন পারসনস রিপোর্ট-২০২৫ প্রকাশিত হয়েছে। যে রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ সরকার মানব পাচার রোধে কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে এখনও ন্যূনতম মান পূরণে ব্যর্থ। তার আগে ইউএনএইচসিআর ও আইওএম এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘রোহিঙ্গাদের পাচার এখন সবচেয়ে বড় হুমকি। আন্তর্জাতিক সহায়তা না বাড়লে তারা আরও বিপদে পড়বে।’
রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি, উন্নত জীবনের আশায় মালয়েশিয়া যাওয়ার বা ক্যাম্প থেকে পালানোর প্রবণতা রোহিঙ্গাদের মধ্যে বরাবরই ছিল, তবে ইদানীং তা হুট করেই বেড়ে গেছে। যাদের আত্মীয়-স্বজন বিভিন্নভাবে মালয়েশিয়ায় গিয়েছে, তাদের মধ্যেই সেদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে বলেও জানান তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গা দালালরাই সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের এ রুটটি আবিষ্কার করে। অস্বচ্ছল ও বেকার যুবকদের জীবন বদলে দেয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে নগদ ১০ থেকে ২০ হাজার ও দেড়-দুই লাখ টাকা বাকিতে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার শর্তে ফাঁদে ফেলছে; বিশেষ করে যুবকদের।
টেকনাফের লেদা ডেভেলপমেন্ট ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘উন্নত জীবনের আশায় মালয়েশিয়া যাওয়ার বা ক্যাম্প থেকে পালানোর প্রবণতা রোহিঙ্গাদের মধ্যে বরাবরই ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের তৎপরতা না থাকায় মানবপাচার বন্ধ হচ্ছে না। যাদের আত্মীয়-স্বজন বিভিন্নভাবে মালয়েশিয়ায় গিয়েছে, তাদের সেদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। এখন সমুদ্র কিছুটা শান্ত, সেই সুযোগে তারা মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছে’ যোগ করেন তিনি।
জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সাগরপথে মানব পাচারের ঘটনায় কক্সবাজারে ১ হাজার ১৩৪ মালয়েশিয়াগামীকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্য বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। এসব ঘটনায় উখিয়া-টেকনাফ থানায় ১২’শ জনকে আসামী করে ৮৫টি মামলা করা হয়েছে। এদের মধ্য ৫০৮ জন পাচাীকারীকে আটক করা হয়েছে।
মানব পাচার থামছে না কেন জানতে চাইলে টেকনাফ থানার ওসি আবু জায়েদ নুর বলেন, ‘আমরা মানব পাচার রোধসহ অপহরণকারীদের ধরতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু পাচারের শিকার যাত্রীরা অনেক সময় স্বেচ্ছায় দালালদের সাথে মিলে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জিংয়ে পড়তে হয়। তবে আমরা স্থানীয় পর্যায়ে যেসব মানব পাচারকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠছে, তাদের ধরতে আমাদের অভিযান চলছে।’
যৌথ অভিযানে অংশ নেওয়া র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের স্থানীয় ইউনিটের (র‌্যাব-১৫) কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসান জানান, ‘এই চক্রের সদস্যরা অস্ত্রধারী। তারা পাহাড়ে গুলি চালিয়ে ভয় ছড়ায়। যাতে নির্বিঘ্নে ভিকটিমদের বন্দি করে রাখতে পারে।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরণের আরো সংবাদ পড়ুন...
  • নামাজের সময়সূচি
  • শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫
  • সূর্যোদয় :- ৫:১০ সূর্যাস্ত :- ৬:৪৯
    নাম সময়
    ফজর ৪:১৫
    যোহর ১২:১০
    আছর ৪:৫০
    মাগরিব ৬:৪৫
    এশা ৮:১৫