উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৭টি বড় সশস্ত্র গোষ্ঠি সক্রিয় থাকার তথ্য দিয়েছেন রোহিঙ্গা সহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। একই সঙ্গে আরও অন্তত ছোট-ছোট সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। যাদের আধিপত্য বিস্তার ও সদস্য বাড়ানোর অপতৎপরতায় বলি হচ্ছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের নির্যাতন নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা সংকট এখন আট বছরে এসে দাঁড়িয়েছে। আর এই আট বছরে এসে স্বয়ং রোহিঙ্গাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠি আতংক।
সাধারণ রোহিঙ্গারা বলছেন, দিনের বেলায়ও অস্ত্রধারীদের চোখরাঙানি, চাঁদাবাজি ও অপহরণের ভয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা ঘর থেকে বেরোতে সাহস পান না। আর রাতের রোহিঙ্গা ক্যাম্প মানেই আতংক।
সাধারণ রোহিঙ্গা, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি (সর্দার) এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া তথ্য মতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে, সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় ৭টি বড় ধরণের সশস্ত্র গোষ্ঠি রয়েছে। এর বাইরে অন্তত ৫০ টি ডাকাত গ্রুপ রয়েছে ক্যাম্পে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে যে ৭টি বড় সশস্ত্র সংগঠন সক্রিয় রয়েছে তা হল, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা, আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি বা এআরএ, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন বা আরএসও, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন অর্গানাইজেশন বা এআরএসও, আরাকান রোহিঙ্গা লিবারেশন আর্মি, কোম্পানি গ্রুপ ও ইসলামী মাহাজ।
এরা নিজেদের আধিপত্য বজায় এবং অস্ত্র-মাদক নিয়ন্ত্রণ রাখতে পরস্পরের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। সাধারণ শরণার্থীরা মাঝখানে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন।
ক্যাম্পের কয়েকজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কর্মসংস্থান নেই, স্কুল-কলেজ নেই, বাইরে কাজ করতে পারি না। যারা শক্তিশালী, তারা অস্ত্র কিনে দল গড়ে তোলে, আর আমরা বাঁচতে হলে তাদের কথাই শুনি।
১০ নম্বর ক্যাম্পের ৬০ উর্ধ্ব বৃদ্ধ আবদুল গফুর জানান, বড় যে গোষ্ঠি আছে তাদের মধ্যে একটি অপরটির প্রতিপক্ষ। এরা রোহিঙ্গাদের ঘরে থাকা তরুণদের নিজেদের সদস্য হিসেবে অর্ন্তভূক্ত করার প্রতিযোগিতায় আছে। যদি কোন একটি দলের সদস্য হয়ে থাকে তাহলে অন্য গোষ্ঠিগুলো টার্গেট নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। আর কোন দলের সদস্য না হলে আরও বিপদ। সবার ভয়ে দিন-রাত অতিবাহিত করতে হয়।
বড় গোষ্ঠি গুলো কেন সদস্য বাড়াতে চায় সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই তাঁর। তিনি বলেন, কখনও আরাকানে ফিরে যুদ্ধ, আবার কখনও রোহিঙ্গা পক্ষের শক্তি বাড়ানোর কথা বলে এরা। কিন্তু মাদক কারবার, অস্ত্র বেচা-বিক্রি, চাঁদা আদায়, অপহরণ ছাড়া কোন কিছু করতে দেখা যায় না এদের।
৬ নম্বর ক্যাম্পের এক মাঝি (সর্দার) নাম প্রকাশ করার শর্তে জানান, এসব ছোট-বড় গোষ্ঠির নির্যাতনে রোহিঙ্গারা নিরাপত্তাহীন। এরা রোহিঙ্গাদের ক্ষতি করছেন।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে (জানুয়ারি-জুন) রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০ ধরণের অপরাধের বিপরীতে ২৩১ টি মামলা লিপিবদ্ধ হয়েছে।
যেখানে খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৫ টি। যে মামলার বিপরীতে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা অন্তত ২০ টি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদক সংশ্লিষ্ট। মাদকের মামলা ১১০ টি। একই সঙ্গে অপহরণের ১৬ টি, ধর্ষণের ১২ টি মামলা রয়েছে।
মুলত ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানে পালিয়ে আসা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তখন মানবিক সহায়তার হাত প্রসারিত হয়। এরপর গত ৮ বছরের ৩০০ শতাধিক খুনের ঘটনায় ২৮৭ টি মামলা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ বলছে, এসব মামলার কারণ খুঁজতে গিয়ে তথ্য মিলেছে সশস্ত্র গোষ্ঠির আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব খুনের ঘটনা সংগঠিত হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের মিডিয়া কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসীম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অপরাধের মূল নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। আধিপত্য বিস্তার নিতে সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এর বাইরে মাদক কারবারে জড়িত একটি বিশাল অংশ। জেলা পুলিশ মামলা তদন্ত, অপরাধীদের গ্রেপ্তারে প্রধান দায়িত্ব পালন করেন। ক্যাম্পের ভেতরে এপিবিএনকে সহায়তা প্রদান করেন। পুলিশ, র্যাব সহ অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মিলে সর্তকভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
অভিবাসন ও রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞ আসীফ মুনীর জানান, নানা হতাশায় নিমজ্জিত রোহিঙ্গারা। প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত, বেকার জীবন, ভবিষ্যৎ চিন্তার উপর হতাশাগ্রস্থ রোহিঙ্গা তরুণের মগজে অপরাধ জন্ম হচ্ছে। তারা ছোট ছোট গোষ্ঠি তৈরি করে শক্তি বা ক্ষমতা প্রদর্শন করে অর্থ আয়ের দিকে যেতে আগ্রহী হচ্ছে। একই সঙ্গে বড় যে সশস্ত্র গোষ্ঠির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তারাও রোহিঙ্গাদের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের যে লক্ষ্যে কাজ পরিচালনা করার কথা তা কিন্তু কোন সময় দেখা যায়নি।
এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা তরুণদের সচেতন করে অপরাধ থেকে বিরত রাখার উদ্যোগ নেয়া জরুরি।
সূর্যোদয় :- ৫:১০ | সূর্যাস্ত :- ৬:৪৯ |
নাম | সময় |
ফজর | ৪:১৫ |
যোহর | ১২:১০ |
আছর | ৪:৫০ |
মাগরিব | ৬:৪৫ |
এশা | ৮:১৫ |