বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৫৫ অপরাহ্ন

ভাঙা বাঁধে কুতুবদিয়াবাসির কান্না

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট সোমবার, ৪ আগস্ট, ২০২৫, ১২:১৩ অপরাহ্ন

কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় ভাঙা বেড়িবাঁধ যেনো উপকুলবাসীর কাছে আতংক। কয়েকদফা বিলীন হয়েছে বসতঘর, সর্বস্বান্ত হয়েছে দ্বীপটির অনেক বাসিন্দা। কিন্তু ৩৪ বছরেও টেকসই বেড়িবাঁধ পায়নি কুতুবদিয়াবাসি। উল্টো প্রতি বর্ষায় সংস্কারের নামে লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ জনপ্রতিনিধিদের। তবে টেকসহ সুপার ডাইক নির্মাণের জন্য প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের ষাটপাড়ার ৫৫ বছর বয়সী মোস্তফা বেগম। ১৯৯১ সালের প্রলয়কারি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বসতভিটা হারানো পর বেড়িবাঁধে ঝুপড়ি ঘরে তার বসবাস। কিন্তু গত কয়েকদিনের উচ্চ জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিলীন শেষ আশ্রয়স্থলটিও; বলছিলেন, তিনি এখন সর্বশান্ত।
মোস্তফা বেগম বলেন, “স্বামী পাগল, কোথায় থাকে জানি না। দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করতাম। কিন্তু সাগরের উচ্চ জোয়ারে ঢেউয়ের আঘাতে ঘরটি বিলীন হয়ে গেছে। ১৯৯১ সালের পর থেকে সাগরের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করছি, আর পারছি না। আর শক্তি নেই, ঘরও সাগর নিয়ে গেছে। কোথাও যদি জমি থাকতো তাহলে ওখানে গিয়ে ঘর বেঁধে থাকতাম। কিন্তু ঘর বা ভিটা কিছুই তো আর নেই, এখন সর্বশান্ত।”

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, কুতুবদিয়ায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৪০ কিলোমিটার, যার মধ্যে সাড়ে ৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত। আর সম্প্রতি বিলীন হয়েছে ৮০০ মিটার বেড়িবাঁধ।

কুতুবদিয়ার সাগর তীরবর্তী বায়ু বিদ্যুৎ, তাবালেরচর, কাহারপাড়া, হায়দারপাড়া, তেলিপাড়া ও আনিছের ডেইল এলাকা। এসব এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বেড়িবাঁধ সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। আশপাশে বাঁশ-কাঠ-পলিথিন ও টিনের ছাউনিযুক্ত ঝুপড়ি তৈরি করে বসতি করছে মানুষ। বাসিন্দারা জানান, মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫ মাস উত্তাল থাকে সাগর। এখন সাগরের উচ্চ জোয়ারে প্রতিনিয়ত বেড়িবাঁধ ভাঙছে। যার কারণে আতঙ্কে দিন কাটে তাঁদের।
সরেজমিন দেখা যায়, জোয়ারের পানিতে বেশ কিছু ঘর প্লাবিত হচ্ছে। ঘরের উঠানে রোপণ করা কিছু নারকেলগাছ সাগরে বিলীন হওয়ার পথে। ছোট্ট একটি ঝুপড়িতে বসবাস করেন সত্তর বছরের বৃদ্ধা মরিয়ম বেগম। জীবনে তিনি ৫০টির বেশি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস দেখেছেন বলে জানান। ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে নিজের চার মেয়েকে হারিয়েছেন জানিয়ে মরিয়ম বেগম বলেন, সাগরে দিন দিন বিলীন হচ্ছে দ্বীপ। গত তিন দশকে বসতবাড়ি ও পেশা হারিয়ে দ্বীপের অনেক মানুষ অন্য স্থানে চলে গেছেন। যারা রয়ে গেছেন, সবাই আশায় বুক বেঁধে আছেন কখন একটি টেকসই বেড়িবাঁধ হবে।
মরিয়ম বেগম বলেন, ১৯৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের আগে তাঁর বসতবাড়ি ছিল দুই কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের মধ্যেই। তখন তার পাঁচ কানি (দুই একর) জমি ও বসতঘর ভেসে গিয়েছিল। গত তিন দশকে তিনি চারবার ঘর পাল্টিয়েছেন। এখন যে ঘরে থাকছেন, সেটিও জলোচ্ছ্বাসের প্লাবিত হয়।
মরিয়ম বেগমের ছেলে ফরিদুল আলম বলেন, বর্ষাকালে কয়েক হাজার মানুষ চরম আতঙ্কে দিন কাটছে। দুর্যোগের সংকেত পড়লেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দৌড়াতে হচ্ছে।
৫৮ বছর বয়সী কৃষক আলী হোসেন। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে হারিয়েছেন দুই ভাই, দুই বোন ও তিন সন্তান। বর্তমানে স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে তার সংসার।
আলী হোসেন বলেন, তার বাড়িটি যে জায়গায় ছিল, এখন সেখানে জাহাজ নোঙর করে। জায়গাটি তীর থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে। জলোচ্ছ্বাসে ভিটেবাড়ি বিলীন হওয়ায় গত ২৬ বছরে তিনি চারটি ঘর পাল্টিয়েছেন। এখন যে ঘরটি আছে সেটিও ঝুঁকির মধ্যে। এটি যদি সাগর গ্রাস করে তাহলে আরও কোথাও যাবার জায়গা নেই।
এদিকে কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল, কৈয়ারবিল, উত্তর ও দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নসহ ১২টি অংশে ভাঙ্গা ছিল বেড়িবাঁধ। জিও ব্যাগ দিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা একবছরেও ঠিকে না। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বায়ু বিদ্যুৎ, তাবালেরচর, কাহারপাড়া, হায়দারপাড়া, তেলিপাড়া, আনিছের ডেইল এলাকা। ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ দিয়ে প্রতিনিয়ত ঢুকছে জোয়ারের পানি, প্লাবিত হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, গত দেড়-দুই দশকে প্রতি বর্ষা মৌসুমে বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে হয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি।
কুতুবদিয়া দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আল আযাদ বলেন, আজকে বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে কুতুবদিয়া বেড়িবাঁধ নির্মাণ নিয়ে অনিয়ম হচ্ছে। যেখানে অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত প্রত্যেক টেবিল এবং পকেটে ভাগ যায়। তা নাহলে কুতুবদিয়ার বেড়িবাঁধের এ অবস্থা হতো না। কুতুবদিয়ার মানুষের এ দুর্ভোগ হতো না।
আলাউদ্দিন আল আযাদ আরও বলেন, গত তিন দশকে বাস্তুচ্যুত হয়ে কিংবা পেশা হারিয়ে শত শত মানুষ দ্বীপ ছেড়েছেন। দ্বীপে থেকে যাওয়া মানুষগুলোর নানা সংকটে দিন কাটছে। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিকর দিক মোকাবিলায় নানামুখী উদ্যোগ না নিলে সংকট আরও বাড়বে।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, টেকসহ সুপার ডাইক নির্মাণের জন্য প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
কক্সবাজার বাপাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোঃ জামাল মুর্শিদ বলেন, “চলমান অতি বৃষ্টি সঙ্গে সামুদ্রিক সিগ্যানালের কারণে কুতুবদিয়ায় বেড়িবাঁধের প্রায় ২.৫ কিলোমিটার স্থানের ১২টি অংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারমধ্যে ৫টি অংশে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলে কাজ করা হয়েছে। স্থায়ী সমাধানের জন্য মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও মাতারবাড়ির জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আলী আকবর ডেইল ইউনিয়ন ও বাতিঘর এলাকায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার সুপার ডাইক নির্মাণের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রস্তুত করছি। দ্রুত একটি জমা দেয়া হবে।”


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরণের আরো সংবাদ পড়ুন...
  • নামাজের সময়সূচি
  • বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
  • সূর্যোদয় :- ৫:১০ সূর্যাস্ত :- ৬:৪৯
    নাম সময়
    ফজর ৪:১৫
    যোহর ১২:১০
    আছর ৪:৫০
    মাগরিব ৬:৪৫
    এশা ৮:১৫