কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে একের পর এক বন্যহাতির মৃত্যু ঘটছে। করোনাকালেই মারা গেছে অন্তত ১২টি হাতি। এ বছর মারা গেছে আরও পাঁচটি। পাহাড় ন্যাড়া করে লেবুবাগান, প্রভাবশালীদের দখলদারত্ব এবং উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে হাতির চলাচলের পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। খাবার ও পানির অভাবে লোকালয়ে ঢুকে কখনও বিদ্যুতায়িত হয়ে, কখনও গুলিতে, আবার কখনও রোগে মারা যাচ্ছে। পরিবেশবাদীদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই কক্সবাজার হাতিশূন্য হয়ে পড়বে।
উখিয়ায় আবারও হাতির মৃত্যু হয়েছে। ১৭ সেপ্টেম্বর উখিয়া রেঞ্জের সদর বিটের আওতায় দোছড়ি রফিকের ঘোনা এলাকায় মৃত অবস্থায় একটি পূর্ণবয়স্ক বন্যহাতি দেখতে পান স্থানীয়রা। খবর পেয়ে বন বিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করেন বন বিভাগের ঢিলেঢালা ভূমিকায়।
উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, ‘হাতির মৃত্যুর আসল রহস্য জানতে ময়নাতদন্তের রিপোর্টের অপেক্ষায় আছি। তবে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, হাতির শরীরে গুলির চিহ্ন ছিল। ভেটেরিনারি সার্জনের একটি দল প্রাথমিক পরীক্ষায় হাতিটির দেহ থেকে তিনটি সিসার গুলি উদ্ধার করেছে।
এক বছরে পাঁচ হাতির মৃত্যু
শুধু চলতি বছরেই কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগে মারা গেছে অন্তত পাঁচটি বন্যহাতি। এর মধ্যে ১৩ মার্চ উখিয়ার জুমছড়িতে একটি হাতির মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ৫ জানুয়ারি টেকনাফের হোয়াইক্যং বনবিটে প্রসবের সময় মারা যায় একটি হাতি। ১৮ জানুয়ারি হ্নীলা বিটে পাহাড়ি ছড়ায় পাওয়া যায় আরেকটি মৃত হাতি। গত বছরের আগস্টে বাহারছড়ায় বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যায় আরও একটি বন্যহাতি। পরিবেশবিদদের মতে, নিয়মিত মৃত্যুর কারণে হাতির সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। ২০১৭ সালে বন বিভাগ ও আইইউসিএনের জরিপে দেশে আবাসিক হাতি ছিল ২৬৮টি। তবে স্থানীয়দের অভিমত, বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
রোহিঙ্গা আগমনের পর উজাড় বনভূমি
২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা আগমনের পর উখিয়া ও টেকনাফে উজাড় হয়েছে প্রায় ৬ হাজার একর বনভূমি। এসব জায়গা এখন রোহিঙ্গা শিবিরে পরিণত হয়েছে। ফলে হাতির অন্তত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ করিডোর বন্ধ হয়ে গেছে। খাবার ও পানির খোঁজে হাতি এখন নিয়মিত লোকালয়ে ঢুকছে।
আইইউসিএন ও বন বিভাগের তথ্যমতে, গত ১৮ বছরে মানুষের হাতে নিহত হয়েছে ৯০টি হাতি। একই সময়ে হাতির আক্রমণে প্রাণ গেছে অন্তত ৪০ জন মানুষের।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, দেশের অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্পে হাতির চলাচলের করিডোর বিবেচনায় নেওয়া হয় না। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প তার বড় উদাহরণ। এই রেললাইন কেটে যাবে বন্যহাতির অন্যতম তিন বিচরণক্ষেত্রÑ চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ফাসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে। এতে হাতির চলাচলের ২১টি পথ বাধাগ্রস্ত হবে।
লেবুবাগানেই আটকে যাচ্ছে হাতি
কক্সবাজারের পাহাড়ি বনাঞ্চলে দিন দিন বাড়ছে লেবু চাষ। স্থানীয় প্রভাবশালীরা বন দখল করে কাঁটাযুক্ত লেবুবাগান গড়ে তুলছেন। এতে হাতির দীর্ঘদিনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। সম্প্রতি রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের রোয়ারঘোনা এলাকায় বনভূমি দখল করে লেবুবাগান গড়ে তুলেছেন স্থানীয় প্রভাবশালী সাইফুল। জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জে নজির আলমসহ আরও অনেকে একইভাবে বন দখল করেছেন।
ইয়ুথ এনভারনমেন্ট সোসাইটির প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ‘হাতি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে পাহাড়ি এলাকায় বন উজাড় করে লেবুবাগান ও কৃষিজমি তৈরি। এতে হাতিদের প্রাকৃতিক গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে সংঘর্ষ বাড়ছে।
বাপার সভাপতি এইচ এম এরশাদ বলেন, ‘বাঘ রক্ষায় বন অধিদপ্তর যেভাবে গুরুত্ব দেয়, হাতি রক্ষায় সেইভাবে দেয় না। গবেষণার অভাব রয়েছে। বন কর্মকর্তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় তারা মাঠপর্যায়ে হাতি সংরক্ষণে ব্যর্থ।
কক্সবাজার দক্ষিণ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম জানান, গত দুই অর্থবছরে উখিয়া ও টেকনাফে প্রায় ৭৪০ একর বনভূমিতে হাতির নিরাপদ আবাসস্থল, খাদ্য ও করিডোর উন্নয়নের কাজ হয়েছে।
হাতি রক্ষায় প্রয়োজন বিশেষ উদ্যোগ
পরিবেশবিদদের মতে, হাতি রক্ষায় শুধু এক দিনের ‘বিশ্ব হাতি দিবস’ পালন যথেষ্ট নয়। তাদের বিচরণক্ষেত্র ও করিডোর টিকিয়ে রাখতে জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনায় হাতির পথ সুরক্ষিত রাখা এবং বন দখল বন্ধ করতে হবে। এক সময় কক্সবাজারের পাহাড়ি বনাঞ্চল ছিল হাতির প্রধান আশ্রয়। ঝিরি-ঝরনায় খাবার আর পানি পেয়ে দলবেঁধে ঘুরে বেড়াত তারা। এখন বন উজাড়, লেবুবাগান, দখলদারত্ব ও উন্নয়ন প্রকল্পে হাতির সেই স্বর্গভূমি ধ্বংসের মুখে।
সূর্যোদয় :- ৫:১০ | সূর্যাস্ত :- ৬:৪৯ |
নাম | সময় |
ফজর | ৪:১৫ |
যোহর | ১২:১০ |
আছর | ৪:৫০ |
মাগরিব | ৬:৪৫ |
এশা | ৮:১৫ |