সময়টা ১১-১২ টার মধ্যেই হবে, তপ্তদুপুর, ১৭ আগস্ট, ২০০৫, অলংকার মোড়, চট্টগ্রাম। একযোগে ৬৩ জেলার সিরিজ বোমা হামলার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এখনও গা শিউরে ওঠে সেই বিভীষিকাময় চিত্র চোখে ভাসলে। কী বীভৎস! কী গগনবিদারী দৃশ্য!
একটু পেছন থেকেই বলি। আমি মেট্রিকের রেজাল্ট(২০০৫ সালের জুলাইয়ের ০৯ তারিখ) হাতে পেয়ে গরমাগরম Mahabub Morshed ভাইয়াকে (পরীক্ষার আগে ইংরেজি বিষয়ের তালিম নিতে বেশ কয়েকমাস ভাইয়ার কাছে যাই। আমরা ৫ জন বাসায় যেয়ে ভোরবেলায় একসাথে পড়তাম। সরাসরি শিক্ষক হলেও Tareque Mahamud Roni -এর মতোন করে আমরাও ভাইয়া বলে ডাকতাম। ‘স্যার’ সম্বোধনে কেনো জানি গলায় এসে বিঁধতো। অফিসিয়ালি স্যার হলেও কখনও ডাকা হয়নি!) ফোন দিই কী বা কী করা যায়, কোথায় অ্যাডমিশন নিলে ভালো হয়, সাথে আমার অভিপ্রায়টুকুনও ব্যক্ত করি চট্টগ্রামে পড়বার। তিনিও আমার ইচ্ছের প্রাধান্য ঠাহর করে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চাঁটগায় আসার সুপরামর্শ দিয়ে বাধিত করলেন। যে কথার সে কাজ আমি দুএকটা প্যান্ট-শার্ট বগলদাবা করে প্রথমবারের মতো একাই চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হই। খুব সম্ভবত আগস্টের ৩ তারিখ। কক্সবাজার নেমে ভাইয়াকে আবারো ফোন দিই, তিনি বাতলে দিলেন, কোথায় নেমে কোন জায়গা আসতে হবে। আমি একটি ছোট্ট কাগজে সযতনে টুকে নিলাম। কথামতো বহদ্দার হাট হয়ে চকবাজার জামান পর্যন্ত এসে ফোনটা আবারো করতে হলো(বলে রাখা ভালো, ফোনটা কিন্তু দোকান থেকেই করতাম প্রতিমিনিট ৫ টাকা করে। তখন নিজের মালিকানাধীন কোন ফোনসেট ছিলোনা!), তিনি ওখান থেকে সামান্যটুকু হেঁটে ফয়জুন হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াতে বললেন। আমিও আর কারো থেকে জিজ্ঞেস করবার প্রয়োজন মনে না করে সোজা এক রিক্সাওয়ালাকে বললাম, মামা, ফয়জুন হোটেলের সামনে যাবেন? তিনি মনেমনে বললেন, ভাইজান বুঝি এমাত্র শার্টপ্যান্ট পরে স্বর্গ থেকে ভুল করে মর্ত্যে নেমে পড়েছেন! জলদি ওঠুন। তিনি আমাকে তেলপট্টি মোড় হয়ে লালচান্দ রোড দিয়ে সোজা ফয়জুনের সামনে এনে রাখলেন। দশ টাকা ভাড়া হাঁকালেন। আমি চুপচাপ মিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। খানিক্ষণ বাদে আবছার ভাই এসে এহ্সান বলে হাত বাড়িয়ে মোলাকাত করলেন। আবছার ভাইয়ের সাথে আগে থেকেই ভালো জানাশোনা ছিলো মনে এক চিলতে আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে গেলো। অবশ্য মোর্শেদ ভাইই আবছার ভাইকে পাঠিয়েছেন আমাকে রিসিভ করবার জন্য । আবছার ভাই আমাকে ফয়জুন হোটেল থেকে নাস্তা করিয়ে সোজা বাসায় নিয়ে গেলেন। জয়নগর সবুর হোস্টেলের সাথে লাগোয়া নিচতলায় থাকতেন মোর্শেদ ভাই, আজাদ ফার্মেসির Nurul Hossain Azad ভাই, Mohammed Yusuf ভাই, আবছার ভাই ও টেকনাফের একজন। খুব সম্ভবত আফতাব ভাই। আমি সবার সাথে কুশল বিনিময় করে গোবেচারা হয়ে গুটিসুটি মেরে বসে থাকলাম। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে আছে। কারো সাথে কথাতথা বলার নামগন্ধ নেই। গেঁয়ো গেঁয়ো ভাব যাকে বলে আরকি! সন্ধ্যার দিকে হুসাইন ভাই নাস্তা করালেন জামান হোটেলে নিয়ে। রাতে মেসে আমার জন্য মিল দিয়েছেন মোর্শেদ ভাই। এ প্রথম রাতেই মেস, মিল, বুয়া শব্দগুলোর সাথে পরিচয় ঘটলো। কয়েকদিন পার হলো বেশ আরামসে। কদিন বাদে আমার বড় খালাকে ফোন করে বললাম আমি চট্টগ্রাম এসেছি কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য। আমার ডম্মা মানে বড় খালা বললেন চট্টগ্রাম এসে এখানে না এসে তুই ওখানে কী করিস। আমি পরেরদিন হালীশহর এ ব্লক বাদামতল ডম্মার বাড়িতে গিয়ে হাজির। এবং সেখানেও বিমলানন্দে দিন কাটাতে লাগলাম। এরমধ্যে চিটাগাং কলেজ, মহসীন কলেজ ও সিটি কলেজ থেকে ভর্তি ফর্ম নিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষা করতে লাগলাম। রেজাল্ট প্রকাশ হতে সপ্তাহ দুয়েক লাগবে। এ সুযোগে আমিও অজানা অচেনা চট্টগ্রাম শহরের এদিকওদিক ঘুরছি আর ঘুরছি। আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে!
১৭ই আগস্ট সকালে নাস্তা করে বের হয়ে অলংকার মোড়ের দিকে যেয়ে ঠিক করলাম আজকে সিনেমা দেখবো আকাশে। কতোদিন সিনেমা দেখি না। আকাশ সিনেমা হলটি এখন আর চলে না বোধহয়। চট্টগ্রামের সিনেমা হলগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়( একজন কাঠখোট্টা সিনেমাখোর হিসেবে হালের সিনেমাহলগুলোর বেশুমার অবস্থা আমার জন্য অতিশয় পরিতাপের বিষয়!)। চললেও লক্করঝক্করভাবে দু-একটি চলছে। তো আমি ১২টার শো দেখবো এমনটি ভেবে অলংকার মোড় পুলিশ ফাঁড়ির সামনে করে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছিলাম। হঠাৎ শুনি একটি কানছেঁদা বিকট শব্দ। মানুষ দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করছে। আমি হতবিহ্বল হয়ে চোখ ছানাবড়া করে এককোনায় দাঁড়িয়ে ঘটনা আদতে কী ঘটেছে কিছুই বুঝে ওঠতে পারিনি। প্রথমে মনে করেছি গাড়ির টায়ার তায়ার ব্লাস্ট হয়েছে। খানিকক্ষণ বাদে উদভ্রান্ত মানুষজন বলাবলি করতে লাগলো পুলিশ ফাঁড়ির বিপরীতে মুচির দোকানের বাক্সের ভেতর থেকে বোমা ফেটেছে। হঠাৎ বাক্সের ভেতর থেকে বোমা ফাটছে শুনে অলংকার মোড়ের দোকানিদের মধ্যে হইহই রব পড়ে গেলো। হায় আল্লাহ হায় আল্লাহ এটি কীভাবে সম্ভব!
অতঃপর বেবাক লোক ঘটনার কার্যকারণ বের করতে তথা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠলো। অনেকে মুচিকে দুষছেন। আবার অনেককে মুচির বাক্সে চুপিসারে কেউ রেখে গিয়েছেন বলেও অনুমান করছেন। ইন্টারেস্টিংলি বোমা ফাটার সময় মুচি নিজেই বাক্সের পাশে ছিলেন না। তাই সন্দেহের তির তার দিকে বেশি ঝুঁকছে। পুলিশ মুচিকে অ্যারেস্ট করলেন কিছুক্ষণের মধ্যে। বাকি ঘটনা কী হয়েছে আমার জানা নেই। তাড়াহুড়ো করে আমি অলংকার মোড় ত্যাগ করে হালীশহরে বাসায় ঢুকে টিভি অন করতে দেখি বড়বড় লাল স্ক্রলে ৬৩ জেলায় একযোগে জেএমবির সিরিজ বোমা হামলা খবর দেখাচ্ছে। আমি তাজ্জব বনে গেলাম। তখন ফেসবুকের মতো তড়িৎ সংবাদবাহন ছিলো না বলে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং করাটা বেশ সময়সাপেক্ষ ছিলো।
পরেরদিন অধিকাংশ পত্রিকার হেডিংও সিরিজ বোমা হামলায় ঠাসা। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর আবারও গোটা দেশ কাঁপলো, জেএমবি আবারও তাদের শক্তি জানান দিলো দেশব্যাপী, একযোগে ৬৩ জেলায় জেএমবির শক্তি প্রদর্শন এরকম বহু শিরোনামই ছিলো ২০০৫ সালের ১৮ তারিখের পত্রিকাগুলোর। সেদিনের কথা ভাবতে আমি এখনও চোখে সর্ষে ফুল দেখি। ভয়ে আতংকে গা শিরশির করে!
সূর্যোদয় :- ৫:১০ | সূর্যাস্ত :- ৬:৪৯ |
নাম | সময় |
ফজর | ৪:১৫ |
যোহর | ১২:১০ |
আছর | ৪:৫০ |
মাগরিব | ৬:৪৫ |
এশা | ৮:১৫ |